আমরা সবাই আরও বেশি উৎপাদনশীল হতে চাই তবে কোন কর্ম সম্পাদন শুধই চাওয়ার উপর নির্ভর করে না বরং তাঁর জন্য চাই তিনটি (প্রেরনা, সামর্থ্য ও উদ্দীপক) নিয়ামকের সন্নবেশ । সব কাজ সমান গুরুত্বপূর্ণ নয় তার জন্য দরকার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজ করা ।
কাজ আসে বিভিন্ন উৎস থেকে, যেমন ধরুন বিদ্যুতের বিল দেয়া, ইমেইল পাঠানো, কোন আত্মীয়কে ফোন দেয়া, কোন সহকর্মী একটা সাহায্য চাইল, ফেসবুকে কোন বন্ধুকে বার্তা পাঠানো এগুলো সবই কাজ কারণ এরা সময় এবং কর্মক্ষমতা দুটিই নেয়। আমাদের মনে রাখতে হবে কর্ম উৎপাদনশীলতার একটা সীমা আছে অর্থাৎ আমরা কোন নির্দিষ্ট সময়ে ইচ্ছাদিন কাজের একটা পরিমানই সম্পন্ন করতে পারি।
উৎপাদনশীলতা = সম্পাদিত (মূল্যবান) কাজের পরিমান / কাজে নিবেদিত সময়ের পরিমান
কর্ম উৎপাদনশীলতা হলো কর্ম সম্পাদনের ক্ষেত্রে কোন ব্যক্তির দক্ষতার একটি পরিমাপ। আমরা প্রায়শই ধরে নিই যে উৎপাদনশীলতা মানে প্রতিদিন বেশি বেশি কাজ করা, আসলে ধারাবাহিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলি করতে পারাই মূল কথা। কাজের মান এখানে তাৎপর্যপূর্ণ কেননা বেশিরভাগ কর্মের মূল উদ্দেশই অন্যের সুবিধা করা আর তা নিশ্চিত করার জন্য কর্ম সম্পাদন করতে হবে দক্ষতার সাথে গুণমান ঠিক রেখে।
প্রথমেই আমরা ছোট-বড়, কম কিংবা বেশি গুরুত্বপূর্ণ সমস্ত কাজের একটা তালিকা তৈরি করতে পারি। তারপর আমরা প্রত্যেকটি কাজ পর্যালোচনা করে এদেরকে গুরুত্ব ও জরুরত হিসাবে ভাগ করে নিতে পারি। তাহলে আমরা দেখব যেঃ কোন কাজ আমাদেরকে এখনি শেষ করতে হবে, আবার কোনটাকে আমরা পরিকল্পনা ভিতরে নিয়ে নিতে পারবো। আবার দেখব যে কিছু কাজ অন্য কাউকে দিয়ে করিয়ে দিতে পারব অথবা তালিকা থেকে মুছে ফেলতে পারবো। কোন কাজ হাত দেওয়ার আগে সেটার অগ্রাধিকার ও গুরুত্ব বোঝা খুবই গুরুত্বপূর্ণ দরকারি যাতে করে আমরা কর্মশক্তি ও একাগ্রতাকে মূল্যবান কাজে লাগাতে পারি।

ব্যক্তির উৎপাদনশীলতা কাজের ও ব্যক্তিগত সক্ষমতা, নিজস্ব প্রচেষ্টা এবং অনিয়ন্ত্রিত প্রতিবন্ধকের উপর নির্ভরশীল [ক] । এ চারটি কারনের মধ্যে কাজের সক্ষমতা প্রযুক্তিগত নিয়ামক (যেমনঃ সরঞ্জাম, উপকরণ), কাজের পরিকল্পনা, ও বস্তুগত যোগানের উপর নির্ভর করে। অন্যদিকে ব্যক্তিগত সক্ষমতা কর্মীর জ্ঞান, দক্ষতা এবং সামর্থ্য দ্বারা প্রভাবিত। কাজ ও ব্যক্তিগত সক্ষমতা সম্মিলিতভাবে কোন কর্ম সম্ভাব্যতা তৈরি করে যা কর্মীর প্রচেষ্টার (অর্থাৎ ব্যক্তির আচরণ ও বিশ্বাসের প্রকারান্তে কাজের প্রেরণা) সংযোগে নির্দিষ্ট সময়কালীন কর্ম সম্পাদনের মাধ্যমে প্রকৃত উৎপাদনশীলতা আনে। কিন্তু অনিয়ন্ত্রিত প্রতিবন্ধক যেমনঃ উপাদানের ঘাটতি, বিদ্যুৎ বিভ্রাট ইত্যাদি অনেক সময় এড়ানো যায় না যা উৎপাদনশীলতার ব্যতয় ঘটায়।
যদি সহজভাবে দেখি তবে বলেত পারি কমসম্ভব শক্তি ব্যয়ে যথাসম্ভব দ্রুত সঠিক গন্তব্যে পোঁছানোই উত্পাদনশীলতার মূলনীতি। ব্যক্তিগত পর্যায়ে কর্ম উৎপাদনশীলতা বাড়াণোর ০৫ টি মূলমন্ত্র…
১) দুর্বলতা বিবেচনা করে কৌশলগত সামঞ্জস্য আনতে হবে
মনে রাখতে হবে আমরা বর্তমানে যে পরিবেশে বসবাস করি তা মানুষের সাম্প্রতিক মানিয়ে নেয়ার অংশ আর এ কারণেই হয়তোবা আমাদের পরিবেশটাই ভুল, আমরা না। হাজার বছর যাবত আমরা আফ্রিকার জঙ্গলে ছিলাম । চিন্তা করে দেখুন আমাদের প্রাগৈতিহাসিক মাতা-পিতারা কি কখনো চিন্তা করেছিল যে একটা মেশিনের পিছনে বসে প্রতিদিন ৮ ঘণ্টা ১০ ঘন্টা সময় ব্যয় করবে এবং বিশ্বের অনেক অনেক মানুষের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলবে। বলতে পারেন অনেকেই এটা করছে, আমি কেন পারব না সেটা; সত্য তবে সবাই মনে মনে প্রাকৃতিকভাবেই একটু হতাশা বোধ করে যা স্বাভাবিক সুতরাং আপনার ভিতরে যদি এরকম কিছু হয় সেটাকে মেনে নেয়া এবং উতরে যাওয়ার চেষ্টা করাটাই আসল কথা।
আবার সব মানুষ সমান না, কারোর দক্ষতা বেশি, কারোর কম – এ কারনে নিজেকে জানা গুরুত্বপূর্ণ। যেমন ধরুন আমি জানি যে রাস্তায় দৌড়াতে গেলে আমার হাঁটুতে ব্যথা হয়, যার কারনে উঁচু-নিচু রাস্তা দেখে আমাকে সাবধান হতে হবে । অর্থাৎ ‘দুর্বলতা’ সম্পর্কে সচেতন হওয়া এবং সেই অনুসারে কৌশলগুলি সামঞ্জস্য করা উচিত।
আমরা আসলে বসবাস করি আমাদের শরীরের ভিতর, আর সেই কারনে শরীরই আসল বাড়ি যার দেখভাল করা আমাদের দায়িত্ব। আমরা বর্তমানে যে আমার নিশ্চল জীবনযাপন করছি তা কিন্তু ২/৩ প্রজন্ম আগেও ছিল না কারণ আমাদের পূর্বপুরুষরা সারাদিন হাড়ভাঙ্গা খাটুনি করে কৃষিজ উৎপাদন করেছেন। আর সেই জন্যই হয়তোবা আমরা নিশ্চল জীবনের সাথে সম্পর্কযুক্ত বিভিন্ন অসুখের (যেমনঃ ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ) কথা তেমন একটা শুনতে পাইনা। আর মানুষের বিবর্তনের কথার হিসেবে নিলে এটা নিশ্চিত যে আমরা দিনের লম্বা একটা সময় দৌড়ে বেড়িয়েছি শিকার ধরার জন্য সুতরাং আমাদের শরীর ৮/৯ ঘন্টা বসে থাকার জন্য তৈরি হয়নি । নিয়মিত ব্যায়াম করা, নিদেনপক্ষে উঠা-বসা সহ নড়াচড়ার জীবন মনের দিকে খেয়াল রাখা খুবই জরুরী।
মানুষের বিবর্তন সম্পর্কে জানা আমাদের ‘দুর্বলতাগুলি’ বোঝার জন্য যথেষ্ট সহায়ক হয়। মনে রাখতে হবে স্বীকার করি বা না করি মানুষ একটা জৈবিক অ্যালগরিদম যাকে ম্যানিপুলেট করা যায় আর এই কথা মেনে নিয়েই শরীর, মন ও নিজের দুর্বলতার কথা হিসেবের মধ্যে নিয়ে কৌশলগত সামঞ্জস্য আনতে হবে।
২) কাজের তালিকা ও কর্ম পরিকল্পনা উৎপাদনশীলতার সারবত্তা
কোথাও যেতে হলে যেমন গন্তব্য ও রাস্তা সম্পর্কে জানা থাকতে হবে সেরকম কোনো কাজ করতে হলো থাকতে হবে তার পরিকল্পনা । তবে খুব কম লোকই তাদের দিনগুলি পরিকল্পনা ও হিসাব মত কর্ম সম্পাদনে ব্যয় করে, বেশিরভাগ সময়ই তারা কাজ শুরু করে দেয় । কিন্তু তাদের সমস্যা হল যদি আপনি না জানেন কি শেষ করতে হবে, কি ধরনের চাওয়া পূরণ করতে হবে তাহলেই কাজ সম্পাদন কঠিন হয়ে ওঠে আর তা হয়তো বা প্রয়োজনীয় উপকার করবেই না।
পূর্ব আশানুরূপ কর্ম উৎপাদন পাওয়ার জন্য প্রতিদিনই দিনের শেষে পরের দিন বা পরবর্তী কার্যদিবসে কি কাজ সম্পাদন করব তার একটা তালিকা থাকলে ভালো ফল পাওয়া যায়। পরিকল্পনা করা উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ কেননা সেক্ষেত্রে আপনি অনাকাঙ্ক্ষিত ভুল, কম গুরুত্বপূর্ণ কাজ এড়াতে পারবেন। দ্বিতীয়ত, এটি মানসিক প্রশান্তি দেবে এব কাজে একাগ্র থাকতে সহায়তা দিবে।
৩) কার্যোদ্ধারে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে
যখনই আমরা জেনে গেলাম এবং মেনে নিলাম কোন কাজ করছি ঠিক তখন উৎপাদনশীলতাই মূল লক্ষ্য বস্তু। এখন আমাদেরকে সর্বশক্তি নিয়ে সে কার্যটি উদ্ধারে নেমে পড়তে হবে । আর সর্বশক্তি কথাটি বললাম কারণ কারণ আমাদের কার্যকারিতা ও দক্ষতা নির্ভর করে আমাদের অভিজ্ঞতা, কাজ করার ধরন, সরঞ্জাম ও প্রযুক্তির ব্যবহার, বুদ্ধিমত্তা এবং একাগ্র কর্ম প্রবাহের ওপর ।
ব্যয় করার জন্য মানুষের মনোযোগের পরিমান সীমিত। যদি এগুলি একটি কার্যকে কেন্দ্র করে ব্যয় করা যায় তবে আপনার চারপাশে আর কী চলছে তা টের পাবেন না । আর এই প্রবাহই কাজ করাকে আনন্দিত করে তোলে আর জোগায় কর্মশক্তি। সাধারণত সকালের দিকেই মনের জোর এবং প্রেরণা শক্তি বেশি থাকে সেজন্যই যদি সকালের দিকেই হয় তবে দিনের বড় কাজটি তখনই করে ফেলতে হবে ।
কর্মপ্রবাহ আমাদের মনোযোগকে কেন্দ্রীভূত করে কম গুরুত্বপূর্ণ কাজ এড়াতে সাহায্য করে, এবং ব্যর্থতার দুশ্চিন্তামুক্ত থাকি, এমনকি কখনো কখনো সময়জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।
৪) চিত্তবিক্ষেপ ও প্রতিবন্ধকতা উৎপাদনশীলতার প্রধান প্রতিপক্ষ
কাজ করা ঘুমের মত অর্থাৎ আপনি যেরকম বিছানায় শুয়েই ঘুমিয়ে পড়তে পারেন না অর্থাৎ কিছুক্ষণ একাত, ওকাত করে ঘুমিয়ে পড়েন । আবার গভীর ঘুমে যেতে কিছুক্ষণ হালকা ঘুমাতে হয় । ধরুন মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেল তাহলে কিন্তু আপনাকে আবার হালকা ঘুম দিয়ে শুরু করতে হবে, হঠাৎ করে আপনি গভীর ঘুমে চলে যেতে পারবেন না। কাজের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ মানুষ কখনও সঠিক কর্ম প্রবাহে পৌঁছায় না। ঐ অবস্থায় যাওয়ার জন্য কিছুটা প্রচেষ্টা দরকার এবং বেশিরভাগ লোক সেখানে পৌঁছানোর আগেই কোন না কোন চিত্তবিক্ষেপ কিংবা প্রতিবন্ধকতা এসে হাজির হয়।
যদি প্রতি ১০ মিনিটে আপনার কাজ থেকে বিক্ষিপ্ত হন তবে আপনি কখনই সত্যিকারের উৎপাদনশীল হবেন না। ঘুমের মতই, কর্মে এইসব বিভ্রান্তির কারনে পূর্ণ উৎপাদনশীলতায় যেতে নতুন করে শুরু করতে হয় ।
মুলত চিত্তবিক্ষেপ ও প্রতিবন্ধকতা দুই ধরণেরঃ
- অভ্যন্তরীণ ব্যাঘাত
- বাহ্যিক বাধা
অভ্যন্তরীণ ব্যাঘাত গুলো আসে মনের ভিতর থেকে । আমাদের মস্তিষ্কের হলো বিশ্বের সবচেয়ে বড় অডিও-ভিজ্যুয়াল যন্ত্র যা কিনা যতক্ষণ জেগে থাকি চলতে থাকে। মনের ভিতরে সারাক্ষণ উকি দিতে থাকে বিভিন্ন রকমের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া যা ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে ক্রমাগত প্রাপ্ত উদ্দীপনার ফলাফল । আমাদের মন প্রতিদিন প্রায় ৬০,০০০ চিন্তাভাবনা উকি দেয় এবং প্রায়শই আমরা কোন কোন টায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ি আর নিজের সাথে দীর্ঘ গল্প বা কথোপকথনে জড়িয়ে পড়ি । এই অভ্যন্তরীণ ব্যাঘাত সবসময় লোভনীয়। আপনি এগুলি পুরোপুরি মুছে ফেলতে পারবেন না, তবে নিয়ন্ত্রণ করা জানতে হবে ।
দ্বিতীয় ধরণের বিভ্রান্তি হ’ল বাইরে থেকে বাধা। আমাদের মোবাইল টেক্সট, ইমেল, হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক ইত্যাদির ডাক বা তৎপরতা কিংবা সহকর্মীর সাথে খথোপথন এইসব বাহ্যিক বিভ্রান্তির উদাহরণ ।
উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর জন্য আমাদের জানতে হবে কিভাবে অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক বাধাগুলো দূরে রাখতে হয়। অন্ততপক্ষে ৩০ মিনিট থেকে এক ঘন্টা নিভিরভাবে কাজ করার বুদ্ধি রপ্ত করতে হবে ।
৫) নিজস্ব কার্যকারিতার ও দক্ষতার নিয়মিত যত্ন নিতে হবে
জেলেকে যেমন জালের যত্ন নিতে হয় তেমনি আমাদেরকেও কার্যকারিতা ও দক্ষতার বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন রকমের রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করে যেতে হবে । যেমন ধরুন আপনার কাজের টেবিলটাকে গোছিয়ে রাখা, আপনি যেই কম্পিউটারটি ব্যবহার করেন তাকে আপটুডেট রাখা, অথবা কোন যন্ত্রপাতি ব্যবহার করার উপযোগিতা এবং কার্যকারিতা ঠিক রাখা । সর্বশেষ একটি কথা বলতে চাই, আপনি যে কাজই করুন না কেন তাকে উপভোগ করার চেষ্টা করুন, কারণ তা নাহলে মন আপনার অজান্তেই বিভিন্ন রকমের আভ্যন্তরীণ প্রতিবন্ধকতা নিয়ে আসবে। কারণ প্রকৃতিগতভাবে আমরা সবসময় কষ্ট থেকে মুক্ত থাকতে চাই ।
ফিচার ফটোঃ pixabay.com
লেখকঃ মোহ বাঙ্গালি
[ক] National Research Council. 1994. Organizational Linkages: Understanding the Productivity Paradox. Washington, DC: The National Academies Press. doi: 10.17226/2135.
One thought on “কর্ম উৎপাদনশীলতা কি এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ে তা বাড়াণোর ০৫ টি মূলমন্ত্র”