যুক্তরাজ্যে পাওয়া করোনাভাইরাসের নতুন ধরন সম্পর্কে ৭ টি প্রশ্নের উত্তর সবার জানা উচিত।

যুক্তরাজ্যে করোনাভাইরাসের নতুন ধরন (ভেরিয়েন্ট VUI – 202012/01) শনাক্ত হওয়া ও দ্রুত ছড়িয়ে পড়া নিয়ে ইউরোপসহ বিশ্বজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। পুরো জিনোম সিকোয়েন্সিং, এপিডেমিওলজি এবং মডেলিংয়ের ডেটাগুলি নির্দেশ করছে যে নতুন ভেরিয়েন্ট বা স্ট্রেনটি আগেরগুলোর তুলনায় আরও সহজে সংক্রমণ ছড়াতে পারে । যদিও বর্তমানে এটির কারনে মারাত্মক রোগ বা মৃত্যুর সম্ভাবনা বেশি হওয়ার কোনও প্রমাণ নেই তবে ভাইরাসের আগের ধরনটিকে এটি দ্রুত প্রতিস্থাপিত করছে ।

করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণ করার উপায় একই রকম (অর্থাৎ হাত ধোয়া, মাস্ক পরা, অন্যের থেকে দূরত্ব বজায় রাখা এবং সামাজিক যোগাযোগগুলি হ্রাস করা), ভেরিয়েন্ট যাই হোক না কেন। আমরা অন্যের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ এড়িয়ে চললে তা ছড়াবে না। 

 ১) এটা কি আরো গুরুতর রোগের কারন হবে?

বর্তমানে এমন কোনও প্রমাণ নেই যে এই রূপটি আরও মারাত্মক রোগ বা অতিরিক্ত মৃত্যুর কারণ ঘটাতে পারে – তবে এটি আরও ভালভাবে বুঝতে গবেষণা চলছে যা আসন্ন সপ্তাহগুলিতে ক্রমাগত পর্যবেক্ষণ থেকে জানা যাবে ।

তবে এই ভেরিয়েন্ট এর স্পাইক প্রোটিনের যে পরিবর্তন হয়েছে তা বর্তমান করোনাভাইরাসের থেকে অ্যন্টিজেনিক ভাবে কিছুটা ভিন্ন – এটাই ভয়ের কারণ ।  এই পর্যন্ত প্রাথমিকভাবে চারজন পুনরায় এই ভেরিয়েন্ট দ্বারা সংক্রমিত হয়েছে বলে জানা গেছে কিন্তু এ ব্যাপারে আরও অনেক গবেষণা দরকার ।

২) কেন এটি বেশি সংক্রামক?

এই ভাইরাসটির নতুন রূপটির উপর প্রাথমিক যেসব বিশ্লেষণ হয়েছে তা থেকে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। এ গুলোর মধ্যে ভাইরাসটির স্পাইক প্রোটিনের পরিবর্তন খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটির মাধ্যমেই ভাইরাসটি মানুষের কোষে প্রবেশ করে।

স্পাইক প্রোটিনের রূপান্তরটিই মনে হচ্ছে এটিকে অতিরিক্ত সংক্রামক করে তুলছে । কিন্তু ভাইরাসের এই ধরনটির মানুষের কোষের প্রবেশ প্রক্রিয়া এবং সংক্রমণ বৃদ্ধির ক্রিয়াটি এখনও বিস্তারিতভাবে জানা যায়নি।

তবে এই ভেরিয়েন্টি আগেরটির তুলনায় সংক্রামনের অল্প সময়ের মধ্যে খুব সহজেই হয়তো নাক ও গলার মধ্যে অনেক সংখ্যায় প্রতিলিপি তৈরি হতে পারে যা কিনা সংক্রামিত ব্যক্তি থেকে হাঁচি-কাশির কিংবা খুব কাছ থেকে কথা বলার মাধ্যমে খুব সহজেই ছড়িয়ে পড়তে পারে ।

যে ভৌগলিক অঞ্চলে করোনা সংক্রমণের হার বেশি সেখানে এই বিশেষ স্ট্রেনটি ধারণার চেয়ে দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে এবং গানিতিক মডেলিংও প্রমাণ করেছে যে এই নতুন ভেরিয়েন্টির সংক্রমণের হার অনেক বেশি । যুক্তরাজ্যের বিজ্ঞানীরা করনাভাইরাসের নতুন ধরনটি ৭০ শতাংশ বেশি সংক্রামক বলে জানিয়েছেন এবং এটি ভাইরাসের আগের স্ট্রেনটিকে প্রতিস্থাপিত করছে যা কিনা আরেকটা ভয়ের কারণ ।

 ৩) এই রূপটি কত দিন ধরে প্রচলিত আছে?

সময়ের সাথে সাথে সমস্ত ভাইরাস পরিবর্তিত হয় এবং নিয়মিতভাবে নতুন নতুন রূপে হাজির হয়। এদিকে দক্ষিণ আফ্রিকায় করোনাভাইরাসের আরেকটি রূপের সন্ধান পাওয়া গেছে। তবে এটি যুক্তরাজ্যে সন্ধান পাওয়া নতুন ধরনের করোনাভাইরাসের সঙ্গে ঐটির সংক্রমণের মিল থাকলেও তারা ভিন্ন ভেরিয়েন্ট। 

সময়ের সাথে সাথে সমস্ত ভাইরাস পরিবর্তিত হয় এবং নিয়মিতভাবে নতুন রূপে উদ্ভূত হয় ।  এই চিত্রটি করনাভাইরাসের বিগত কতগুলো পরিবর্তন দেখানো হয়েছে, যুক্তরাজ্যের রূপটি ডান দিকে বসবে । বলেত পারেন  এটা বর্তমান করোনাভাইরাসের ফ্যামিলি ট্রিঃ মুলত দুটি ব্রিহত পরিবর্তন এখানে দেখা যাচ্ছে, যুক্তরাজ্যের রূপটি দক্ষন আফ্রিকায় পাওয়া (চিত্রে হলুদ অংশ) ধরণটির সাথে অনেক মিল থাকবে হয়তো।

জিনগত প্রমাণ ব্যবহার করে দেখা যাচ্ছে যে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে যুক্তরাজ্যে রূপটি আবির্ভূত হয়েছিল এবং এরপরে নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত সাধারন জনসাধারণের মাঝে এর সংক্রমণের হার খুব নিচু স্তরে ছিল।

নতুন রূপটির সাথে সংযুক্ত সংক্রমণ নভেম্বরে বৃদ্ধি পেতে থাকলেও যখন যুক্তরাজ্যের পূর্বাঞ্চলের লকডাউন এর মাধ্যমেও সংক্রমণকে দমন করা যাচ্ছিল না তখন লন্ডন এবং এসেক্সে সংক্রমণের দ্রুত এই প্রকরণটির সাথে সংযুক্ত একটি ক্লাস্টার আবিষ্কার হয়। নতুন এই বৈশিষ্ট্যের করোনাভাইরাস লন্ডন এবং দক্ষিণ-পূর্ব ইংল্যান্ডে বর্তমানে দ্রুত ছড়াচ্ছে বলে জানিয়েছেন ব্রিটিশ স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা, যা পুরো দেশেই ছড়িয়ে পড়তে পারে ।

৪) এই স্ট্রেন/ভেরিয়েন্ট কি ফাইজার ভ্যাকসিনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধী?

ফাইজার ভ্যাকসিন নতুন স্ট্রেনের বিরুদ্ধে মানুষকে রক্ষা করবে না এমন পরামর্শ দেওয়ার কোনও প্রমাণ বর্তমানে নেই। ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলো বলছে, রূপান্তর বা মিউটেশনের পর করোনাভাইরাস কিছুটা পাল্টে গেলেও সমস্যা হবে না, কেননা টিকা মানুষের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেকগুলো অংশ নিয়ে কাজ করে ।

তবে এটি আরও ভালভাবে বোঝার জন্য অগ্রাধিকার হিসাবে বর্তমানে আরও পরীক্ষাগারে কাজ করা হচ্ছে।

৫) ভৌগলিক বিস্তৃত কতটা?

যুক্তরাজ্যে ১৪৪ টি স্থানীয় কর্তৃপক্ষ জিনোমিকভাবে কমপক্ষে ১ টি করে কেস সনাক্ত করেছে যা নতুন স্ট্রেন দ্বারা সংক্রমিত, যদিও চিহ্নিত বেশিরভাগ সংক্রমণই লন্ডন, দক্ষিণ-পূর্ব এবং পূর্ব অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ রয়েছে।

ইতোমধ্যে এ নতুন ধরনের ভাইরাসটি ইতালি ও অস্ট্রেলিয়ায়ও পাওয়া গেছে। এছাড়া আইসল্যান্ড, ডেনমার্ক ও নেদারল্যান্ডসে নতুন ধরনের করোনাভাইরাসের সন্ধান পাওয়া গেছে। তবে এটি যুক্তরাজ্যে পাওয়া করোনার নতুন স্ট্রেনটি কিনা সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।  

৬) বর্তমান পরীক্ষাগুলি কী এই নতুন রূপটি সনাক্ত করতে পারে?

ল্যাবগুলি পিসিআর পরীক্ষা পদ্ধতি অল্প পরিবর্তন করে এই ভাইরাস সনাক্ত করতে কোন সমস্যা হওয়ার কথা না ।

৭) শিশুদের সাথে করোনাভাইরাসের নতুন এই রূপটি কিরুপ আচরণ করবে?

 বর্তমান করোনাভাইরাস শিশুদেরকে বয়স্কদের তুলনায় কমই সংক্রমণ করে । পরিসংখ্যান মতে শিশুরা প্রায় ৫০% কিংবা তাঁর কম সংক্রমণের শিকার, তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা সংক্রমনের কোন সিমটম দেখায় না । তবে নতুন এই ভেরিয়েন্ট শিশুদেরকে তুলনামূলকভাবে একটু বেশি আক্রমণ করছে বলে প্রাথমিক উপাত্ততে দেখা যাচ্ছে । কিন্তু এটা কিসের সাথে যুক্ত এখনো জানা যায়নি, তবে স্পাইক প্রোটিনের রূপান্তরটিই মনে হচ্ছে সংক্রমনের দিক থেকে শিশুদেরকে বয়স্কদের কাতারে নিয়ে আসছে । এমনও হতে পারে যে এই ভাইরাস সংক্রমণের পরপরই ভাইরাসটি অনেক প্রতিলিপি তৈরি করে যা কিনা সিমটম এবং পরবর্তী সংক্রমণ ছড়ানো দুটোকেই যোগান দেয় ।

মনে রাখতে হবে নতুন এই ভেরিয়েন্ট সংক্রমনের পরে অনেক সংখ্যায় ভাইরাস প্রতিলিপি তৈরি করে যা কিনা সংক্রমণ ছড়িয়ে দেয়াকে ত্বরান্বিত করতে পারে । একই সময়ে যখনই এটি সুস্থ মানুষের শরীরে নতুন ধরনটি প্রবেশ করে তখন তা সহজেই এর পরিবর্তীত স্পাইক প্রোটিনের ব্যবহার করে সহজে কোষে ঢুকে সংক্রমণ শুরু করেতে পারে । আমরা অন্যের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ সহ ভাইরাস নিয়ন্ত্রণ করার অন্যান্য উপায় মেনে চললে তা ছড়াবে না। সংক্রমণ হ্রাস করাই মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত কারন ভাইরাসটিকে আরও বিকশিত হওয়ার সুযোগ দিলে খুবই বিপদ হতে পারে ।

করোনাভাইরাসের গঠন ও সংক্রমণ সহ  A-Z জানতে দেখতে পারেন বাংলা এই লেকচারটি…

লেখকঃ মোহ বাঙ্গালি [আপনি যদি এই সম্পর্কে আরো পড়তে চান এখানে একটা অবলম্বিত তথ্যসূত্র]

About সময় চাকা

আমরা বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসরত কিছু বাংলাদেশী। সময়ের চাকায় আমরা চলেছি সুখের সন্ধানে, সেই প্রস্তর যুগ থেকে শুরু করে আজও চলছে সন্ধান আর অনুসন্ধান । তাই চলুন সময়ের চাকায় পিষ্ট না হয়ে, সময় চাকা ধরে চলতে থাকি, সময়কে সুন্দর করে রাখার আশায়…

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *