ইতিহাস না বুঝাই কি বাংলাদেশসহ অন্যান্য কমনওয়েলথ দেশসমূহের অর্থনৈতিকভাবে গরীব থাকার অন্তর্নিহিত কারণ?

“জানা” এবং “বুঝা” একে অপরের সাথে সম্পর্কিত কিন্তু এক নয়। বুঝার সাথে চেতনা ও জ্ঞানের উপলব্ধি জড়িত । আমরা ইতিহাস জানি কিন্তু তথ্য বিশ্লেষণ করে প্রাসঙ্গিকতার আলোকে কতটা বুঝি কিংবা এর থেকে কি শিক্ষা নেই? যা কিনা ইতিহাস জানার আসল কারন ।

কমনওয়েলথ সদস্যভুক্ত সব দেশগুলোই অতীতে ব্রিটিশ উপনিবেশ ছিল যারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে আন্দোলনের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও দীর্ঘকাল উপনিবেশিক শাসনের অধীনে থাকায় এর নেতিবাচক কিছু প্রভাব এখনও এসব দেশে থেকে গেছে। বাংলাদেশের কথায় ধরা যাক, ১৯৪৭ সালের ১৮ই জুলাইয়ের ভারত স্বাধীনতা আইন অনুযায়ী দেশ ভাগের মধ্য দিয়ে, একই বছরের অগাস্ট মাসে, উপনিবেশিক শাসনের ইতি ঘটে। কিন্তু এরপর পাকিস্তানও একই উপনিবেশিকতার কাঠামোতে আমাদের শাসন ও শোষণ করেছে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত । তারপর থেকে বর্তমান পর্যন্ত আমরাই আমাদেরকে শোষণ করছি । পরিবর্তন হয়েছে শাসকের কিন্তু বদলায়নি শোষণ কাঠামো । তাই অর্ধশতকের আগে উপনিবেশিকতা চলে গেলেও আমরা আজো এর কুফল ভোগ করে যাচ্ছি এবং যেতে হচ্ছে । 

কোন কিছু তৈরি করার আগে আমরা তৈরি করি তার কাঠামো, কিন্তু দেশের মানুষের সেবার কোন কাঠামো আমাদের কিংবা বেশির ভাগ কমনওয়েলথ দেশেই নেই । যার কারনে উপনিবেশিকতার কাঠামোতেই চলছেই দেশ পরিচালনা । বরং সংস্কারের নামে ক্ষেত্র বিশেষে রাষ্ট্র ক্ষমতাকে ব্যক্তি সুবিধার জন্য কুক্ষিগত করা হয়েছে ।

আমলাতন্ত্র হল সবচেয়ে শক্তিশালী শাসনিক রূপ যার মাধ্যমে ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদ (এবং পশ্চিম পাকিস্তানও) তার শক্তি প্রয়োগ করেছিল শোষণের জন্য । রাষ্ট্রযন্ত্রের ক্ষমতার যে শক্তি (সরকারি বিশাল বাংলো এবং দামি গাড়িতে দৃশ্যমান) আর জবাবদিহিতার যে অবাধ অব্যাহতি কিংবা দায়িত্বহীনতার শাস্তি এড়ানোর যে ব্যবস্থা তা উপনিবেশিক শাসকদের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত । ইউরোপীয় রাজারা তাদের আমলাদের এসব অযুক্তিক সুবিধা দিয়েছিল তার রাজ্য শাসনের জন্য কিন্তু আমরা সেই বাবস্থাপনায় এখন তথাকথিত দেশ পরিচালনা করে যাচ্ছি । এ যেন ব্রীজের ফাউন্ডেশন দিয়ে বাঁধ নির্মাণ করা । যার কারনে এখনও ক্ষমতাসীনরা আঙুল ফুলে কলা গাছ এবং আইনের চোখে সহজেই পার পেয়ে যায়।

উপনিবেশবাদকে অনেকে বর্তমান সভ্যতার আর্থসামাজিক ও বিচার বাবস্থাপনার শুরু হিসেবে দেখে । কিন্তু সে সব বাবস্থপনা শুরু হয়েছিলো রাজার সুবিধার্থে ও তার আশেপাশের লোকজনের স্বার্থরক্ষার জন্য।

বাংলাদেশে প্রত্যন্ত অঞ্চলের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিজ্ঞতা থাকলে আপনি হয়তো জানেন যে সরকার পরিবর্তনের সাথে কিভাবে উপাচার্য আসেন ঢাকা থেকেঃ যেন কোন ইউরোপীয় রাজা তার লর্ডকে পাঠাচ্ছেন । তার জন্য দামি গাড়ি, সুপরিশর বাংলো সহ আয়া, বাবুর্চি, পিয়ন ও বাগানি সবাই প্রস্তত । প্রশাসনে এরূপ লর্ডরা উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় সব পর্যায়ে দেখা যায় যদিও আপাত ভিন্ন মনে হতে পারে (তবে অবশ্যই ব্যতিক্রম আছে, যারা মানুষের সেবায় তথাকথিত প্রশাসনিক ব্যবস্থার উপনিবেশিক ভাবধারার বাহিরে থেকে কাজ করেন) ।

প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার উৎস্থল ব্রিটেন সহ সকল ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদ দেশসমুহে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো সকল নাগরিককে সমান সুবিধা দেয় এবং সবাই প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর তাদের দায়িত্তের ব্যপারে বিশ্বাস করেতে পারে । মনে করুন আপনি রাস্তায় কাউকে গাড়ি চালাতে দেখলেন তবে তার গাড়ি চালনার লাইসেঞ্চ নিয়ে আপনার কখনই সন্দেহ হবে না কেননা আপনি জানেন যে প্রতিষ্ঠান এই দায়িত্তে নিয়োজিত সে একাজে ফাঁকি দিবে না । এরূপ সব প্রতিষ্ঠান ও কর্মজীবী মানুষ যার যার দায়িত্ব প্রতিজ্ঞ আর যার সুবিধা পাচ্ছে সবাই । আমাদের নেতা, আমলা, শিক্ষক ও ব্যবসায়ী মহলের ব্যক্তিগত সুবিধার কথা বাদ দিয়ে পরিবর্তনের জন্য কাজ করা উচিত, তাতে সবাই ভাল থাকবে । 

উপনিবেশিক শিক্ষাবাবস্থায় প্রকৃতি, পরিবেশ ও উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সামঞ্জস্য স্থাপন এবং মানবিক গুণাবলি বিকাশের চেয়ে তত্তগত শিক্ষা ও যান্ত্রিক বাবস্থাপনাগত দক্ষতার উপর বেশি জোর দেওয়া হয়েছিল, সেই ধারা আজও দেশে অব্যাহত । বাবহারিক ও প্রযুক্তিগত বিদ্যার প্রসার ঘটেছে শম্বূকগতিতে। রেলওয়ে, যাকে অনেকে উপনিবেশবাদের ভালো লেগাছি হিসেবে দেখে তাও কিন্তু তৈরি হয়েছিলো উপনিবেশবাদকে সাহায্য করার জন্য । আমরা কি পরবর্তীতে আমাদের প্রয়োজনে এটাকে পুনবিন্যস্ত করেছি?

আমরা এখন পিছনে গিয়ে উপনিবেশবাদ মুচে আসতে পারবনা কিংবা কাউকে বিচারের জন্যও পাবনা । কিন্তু নিজের দেশের ইতিহাস জানা ও বুঝার মাধ্যমে অতীতের ভুল গুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে জনকল্যাণমুখী, সবার সহায়ক, জবাবদিহি, ও দায়িত্ববান প্রশাসন ব্যবস্থাপনা তৈরি করতে পারি।

আমরা যদি ব্যক্তিগত পর্যায়ে নিজের দায়িত্বটুকু অন্যের কাছে যেরূপ আশা করি সেরুপভাবে পালন করি তবে সব প্রতিষ্ঠানগুলোে একদিন আমাদের চাওয়া মত হবে কারন সেগুলো আমাদের দিয়েই তৈরি ।  হয়ত সময় লাগবে কিন্তু হবে, আসুন সবাই মিলে বাঁচি, অন্যকে বাঁচতে দেই ।

লেখকঃ মাধবী লতা [আপনি যদি এই সম্পর্কে আরো পড়তে চান এখানে একটা অবলম্বিত তথ্যসূত্র, [চিত্রন উৎস]]

About সময় চাকা

আমরা বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসরত কিছু বাংলাদেশী। সময়ের চাকায় আমরা চলেছি সুখের সন্ধানে, সেই প্রস্তর যুগ থেকে শুরু করে আজও চলছে সন্ধান আর অনুসন্ধান । তাই চলুন সময়ের চাকায় পিষ্ট না হয়ে, সময় চাকা ধরে চলতে থাকি, সময়কে সুন্দর করে রাখার আশায়…

One thought on “ইতিহাস না বুঝাই কি বাংলাদেশসহ অন্যান্য কমনওয়েলথ দেশসমূহের অর্থনৈতিকভাবে গরীব থাকার অন্তর্নিহিত কারণ?

  1. উপনিবেশ সাম্রাজ্যবাদের কলংক আমরা বংশপরম্পরায় বনিয়ে চলেছি।আম্রা ভিন্ন কোনো চিন্তা পরিকল্পনা করতে ব্যারথ। এমনকি এই পদ্ধতি পরিবরতন করার জন্য নুন্যতম চিন্তাশীলতা হারিয়েছি। যার জন্য আমাদের সামগ্রিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *